খুলনা জেলায় ফুলতলা উপজেলার মধ্যডাঙ্গা গ্রাম। এই গ্রামেরই এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শেখ মফিজ উদ্দিন। স্ত্রী লালমতি বিবি এবং একমাত্র সন্তান আকিজকে নিয়ে তার ছোট সংসার। কৃষিপ্রধান ক্রমবর্ধমান গ্রাম। তবু মফিজ উদ্দিনের আস্থা ছিল তার স্বাধীন ব্যবসাতে। তাই তিনি ধান, চাল, নারকেল এবং নিত্য ব্যবহার্য নানান জিনিসের ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। বাবার এই ব্যবসায়ী চেতনার পুরোটাই আয়ত্ত করেছিলেন বালক আকিজ। চারপাশের মানুষের তীব্র দারিদ্র ও অসচ্ছলতার দায়ভার বাল্যকালেই তাকে করেছিল পরিণত ও সচেতন। তাই এক সকালে বাবার কাছ থেকে মাত্র 16 টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আকিজ। সময়টা 1942 সাল। সেই সময় 16 টাকার অর্থমূল্য নেহাৎ কম ছিল না। নানাদিক বিবেচনা করে কাছাকাছি কলকাতা শহরেই পাড়ি জমালো সে। শুরু হল জীবনের একক সংগ্রাম।
আত্মীয়-পরিজনহীন বিশাল শহরে আকিজের একমাত্র আশ্রয়স্থল হল শিয়ালদহ রেলস্টেশন। সেখানেই অনিশ্চিত দিনের শুরু ও রাতের ক্লান্তি যাপন। কী করে একটি সুবিধাজনক ব্যবসা শুরু করা যায়, এই ছিল তাঁর সারাক্ষণের ভাবনা। সারাদিনের একমাত্র খাদ্য ৬ পয়সার ছাতু। এর বেশি খরচের ঝুঁকি নেবার সাহস ছিল না। একদিন স্থানীয় জাকারিয়া হোটেলের মালিকের নজরে পড়েন আকিজ। ভদ্রলোকের সদয় বিবেচনায় সেই হোটেলের একপাশে আশ্রয় জোটে তাঁর। এর মধ্যেই একটি ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পাইকারী দরে কমলালেবু কিনে হাওড়া ব্রিজে ফেরি করার ব্যবসা। এর জন্য পুলিশকে দুই টাকা ঘুষও দিতে হয় তাঁকে। সারাদিন কমলা বিক্রি করে রাতে ক্লান্ত হয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে বালিশ ছাড়া খবরের কাগজ বিছিয়ে ঘুমাতেন তিনি। সেই সময় কলকাতায় আর একটি ব্যবসার সন্ধান পান আকিজ। রাস্তার পাশে ভ্যান গাড়িতে মুদি দোকান। দোকানের নাম নিলামওয়ালা ছআনা। নামেই বোঝা যায় দোকানের প্রতিটি জিনিসের দর ছিল ছআনা করে। কিন্তু সমস্যা হল, অন্য সব দোকানদাররাই ছোট ছোট মজার হিন্দি ছড়া কেটে তাদের জিনিস বিক্রি করত। এদিকে আকিজ একদম হিন্দি জানতেন না। শেষে এক বন্ধুর সহায়তায় অল্পকদিনেই তিনি হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেললেন ব্যবসার খাতিরে। সব মিলিয়ে মোটামুটি ভালোই চলছিল ব্যবসা। কিন্তু অচিরেই ঘটল এক বিপদ। আকিজকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে তিন দিনের জেল ও পাঁচ টাকা জরিমানা হল তাঁর। একটানা জীবনযুদ্ধে একটি বড় ছন্দপতন হল যেন। ক্ষুব্ধ আকিজ জেল থেকে বের হয়েই তাঁর পুরো দোকানটি বিক্রি করে দিলেন।
সাময়িক হতাশা আকিজকে যেন আরো উদ্দীপ্ত করল নতুন কিছুর সন্ধানে। কলকাতাতেই একদিন পরিচয় হল এক পেশোয়ারী ব্যবসায়ীর সাথে। তার হাত ধরে আকিজ পাড়ি জমালেন পেশোয়ারে। জমানো টাকা দিয়ে নতুন করে শুরু করলেন ফলের ব্যবসা। সেই সাথে শিখে নিলেন পশতু ভাষা। এভাবে কেটে গেল দুই বছর। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকাল। অবশেষে দশ হাজার টাকার মুনাফা নিয়ে আকিজ ফিরে এলেন প্রিয়তম বাবা-মার সান্নিধ্যে, নিজের বাড়িতে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাবা-মার মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন আকিজ।
1952 সালে আকিজ প্রথম বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাটির ধারণা তিনি পেয়েছিলেন নিতাই চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তির নিকট থেকে। সেই সময়ের বিখ্যাত বিধু বিড়ির মালিক বিধুভূষণ ছিলেন তাঁরই এক বন্ধুর বাবা। তার অনুপ্রেরণাতেই আকিজ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বিড়ির ব্যবসাটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করেন। ধীরে ধীরে বেজেরডাঙ্গা তাঁর নিজ এলাকায় রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। 1954-55 সালের দিকে এই দোকানে তাঁর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ষাট হাজার টাকা। এরই মাঝে ঘটে যায় আরেক দুর্ঘটনা। একরাতে আকিজের পুরো দোকানটি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অসীম ধৈর্যশীল আকিজ এতটুকু ভেঙ্গে পড়েন নি তাতে। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অচিরেই তিনি গড়ে তোলেন নতুন দোকান। এ সময় তাঁকে সহায়তা করেন ফুলতলা বাজারের কালাকুণ্ডু। তাঁর সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলে কিছুদিনের মধ্যেই মোট মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ টাকা। এরই পাশাপাশি আকিজ শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডাল, গুড় প্রভৃতির খুচরা ব্যবসা। সমস্ত ক্ষেত্রেই আকিজের প্রধান মূলধন ছিল বিশ্বস্ততা। ব্যবসায়ীমহলের সবাই তাঁকে একবাক্যে বিশ্বাস করত।
পরবর্তীকালে ষাটের দশকের দিকে ব্যবসায়িক কারণে চলে আসেন যশোরের সীমান্তবর্তী থানার নাভারণ পুরাতন বাজারে। এখান থেকে বিড়ির ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটান এবং গড়ে তোলেন দেশের সর্ববৃহৎ আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি। নাভারণে আসার প্রথমদিকে ব্যবসা প্রসারে তাঁকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোজাহার বিশ্বাস।
এভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেন আকিজ। নতুন নতুন উদ্ভাবনী মেধার সাহায্যে তিনি উন্মোচন করেন ব্যবসার নানা দিগন্ত। একে একে গড়ে তোলেন আকিজ তামাক ফ্যাক্টরি, আকিজ নেভিগেশন, আকিজ জুট মিল, আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি, আকিজ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ইত্যাদি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এখন প্রায় চল্লিশ হাজার কর্মী তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর প্রায় 100 কোটি টাকা আয়কর পরিশোধ করে যাচ্ছেন। এসবের পিছনে ছিল তাঁর সকাল থেকে রাত অবধি অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধা।
শেখ আকিজ উদ্দিন জীবনের সকল শ্রম-সাধনা কেবল নিজেকে প্রতিষ্ঠার কাজেই ব্যয় করেন নি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি একজন সফল সমাজসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছোটবেলায় দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের করুণ অবস্থা উপলব্ধি করেই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শরিফ হোসেনের সহায়তায় 1980 সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আদ্-দ্বীন। বর্তমানে এই সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান আদ্-দ্বীন মহিলা, শিশু ও চক্ষু হাসপাতাল সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। তাঁর অর্থায়নে পরিচালিত আকিজ কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই যশোর শিক্ষা বোর্ডের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম বহন করে আসছে। এছাড়াও একটি এতিমখানা, একটি বালিকা বিদ্যালয় ও ফোরকানিয়া প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এমন একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। অক্লান্ত পরিশ্রম, কঠোর অধ্যবসায়, আপোষহীন সততা, সর্বোপরি মহান আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আস্থা তাঁকে সফলতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। মেধা ও প্রতিভার সমন্বয়ে গড়ে তোলা তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন হাজার হাজার শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। অর্থ, সম্পদ ও মানবসেবার এ বিরল ব্যক্তিত্ব গত 2006 সালের 10 অক্টোবর তারিখে সকাল 11:20 মিনিটে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় 77 বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। 1929 সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে অর্থনীতি ও সেবার ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হবার নয়।
শিল্পপ্রতিষ্ঠান | |
---|---|
প্রতিষ্ঠানের নাম | প্রতিষ্ঠাকাল |
আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি লিঃ | 1950 |
এস এ এফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ | 1960 |
ঢাকা টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ | 1966 |
আকিজ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ | 1974 |
আকিজ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি লিঃ | 1980 |
নাভারণ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ | 1980 |
জেস ফার্মাসিউটিক্যালস লিঃ | 1986 |
আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিঃ | 1992 |
আকিজ জুট মিলস লিঃ | 1994 |
আকিজ সিমেন্ট কোম্পানি লিঃ | 1995 |
আকিজ টেক্সটাইল মিলস লিঃ | 1995 |
আকিজ পার্টিক্যাল বোর্ড মিলস লিঃ | 1996 |
আকিজ হাউজিং লিঃ | 1997 |
সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ | 1998 |
আকিজ ফুডস এন্ড বেভারেজ লিঃ | 2000 |
আকিজ অন লাইন লিঃ | 2000 |
নেবুলা ইন্ক লিঃ | 2000 |
আকিজ কর্পোরেশন লিঃ | 2001 |
আকিজ কম্পিউটার লিঃ | 2001 |
আকিজ ইনস্টিটউট অব টেকনোলজি লিঃ | 2001 |
আফিল এ্যাগ্রো লিঃ | 2004 |
আফিল পেপার মিলস লিঃ | 2005 |
সেবামূলক প্রতিষ্ঠান | |
প্রতিষ্ঠানের নাম | প্রতিষ্ঠাকাল |
আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট | 1980 |
আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার | 1989 |
আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশন | 2004 |
আদ্-দ্বীন শিশু-কিশোর নিকেতন | 1980 |
আদ্-দ্বীন হাসপাতাল | 1985 |
আদ্-দ্বীন ফোরকানিয়া প্রজেক্ট | 1985 |
আকিজ কলেজিয়েট স্কুল | 1998 |
আকিজ ফাউন্ডেশন স্কুল এন্ড কলেজ | 2010 |